চলতি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের যে দুই শতাধিক নেতা অংশ নিয়েছেন, তাদের দল থেকে বের করে দিয়েছে দেশের অন্যতম প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। এসব নেতার বেশিরভাগই স্থানীয় পর্যায়ে ভালো সংগঠক কিংবা জনপ্রিয় হিসেবে দলের ভেতরে বাইরে পরিচিতি রয়েছে।
দল থেকে বহিষ্কার কিংবা অব্যাহতি পাওয়া এসব নেতার অনেকেই দলটির জেলা, উপজেলা বা পৌর শাখার গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। অনেকে আগেও উপজেলা চেয়ারম্যান কিংবা পৌরসভার মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
দলটি আগে থেকেই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে কোনো ধরনের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ না নেওয়ার জন্য নেতাকর্মীদের সতর্ক করে আসছিল। কিন্তু এবার উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় দলটির অনেক নেতাই দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
এর মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে, পনের বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থেকে দৃশ্যত বিপর্যস্ত বিএনপি, যে নেতাদের মাঠ পর্যায়ে জনপ্রিয়তা আছে কিংবা ভালো সংগঠক হিসেবে পরিচিতি রয়েছে, তাদের এভাবে বের করে দেওয়ায় মাঠপর্যায়ে দলটি সাংগঠনিকভাবে ক্ষতির শিকার হলো কি না। নাকি এটিই দলীয় কৌশল যে, বিএনপি নেতারা দল থেকে অব্যাহতি নিয়ে বা বহিষ্কার হয়েই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে তৃণমূলের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকুক- সে আলোচনাও আছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এবং সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলছেন, দলের সিদ্ধান্ত যারা অমান্য করেছেন তারা নীতি বিবর্জিত। সে কারণেই তাদের বহিষ্কার করা হচ্ছে এবং তাদের বিদায়ে বিএনপির কোনো ক্ষতি হবে না বলেই তারা মনে করছেন।
একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, এতগুলো সংগঠক কিংবা জনসম্পৃক্ততা আছে-এমন নেতাদের বের করে দিলে দলটি আরও দুর্বল হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে তার মতে, এদেশের প্রধান দুই দলে এমন উদাহরণ কম নয় যে, নির্বাচনের আগে দল থেকে বহিষ্কার করলেও পরে আবার দলের ফিরিয়ে নেওয়া হয়।
নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কারণে বহিষ্কার হয়েছেন এমন দুজন নেতা বলেছেন, দলের সিদ্ধান্ত তারা মেনে নিয়েছেন, তবে দলের আদর্শেই তারা অবিচল থাকবেন। তারা দুজনই তাদের নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন।
প্রসঙ্গত, দেশে চার ধাপে উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর মধ্যে প্রথম ধাপের ভোট গ্রহণ গত ৮ মে অনুষ্ঠিত হয়েছে। আর দ্বিতীয় ধাপের ভোটগ্রহণ হতে যাচ্ছে ২১ মে মঙ্গলবার।
বিএনপির দফতর বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত তিন ধাপে অন্তত ২০৯ জনকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে দল থেকে অব্যাহতি কিংবা বহিষ্কার করা হয়েছে।
এর মধ্যে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করায় প্রথম দফার ভোটের আগে মাঠ পর্যায়ের ৭৯ জন নেতাকে বহিষ্কার করেছে দলটি, যার মধ্যে অনেকে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী ছিলেন।
একইভাবে ২১ মে অনুষ্ঠিতব্য দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের আগে দলটি আরও ৬১ নেতাকে এবং ২৯ মে অনুষ্ঠিতব্য তৃতীয় ধাপের ১১২টি উপজেলার ভোটে অংশ নেওয়া ৫১ জন নেতাকে বহিষ্কার করেছে দলটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। এর বাইরেও বিচ্ছিন্নভাবে আরও দশজনের মতো নেতা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কারণে দল থেকে বহিষ্কার হয়েছেন বলে দলটির দফতর বিভাগ জানিয়েছে।
আগামী ৫ জুন শেষ ধাপে ৫৪টি উপজেলায় ভোট হওয়ার কথা রয়েছে। এসব উপজেলাতেও শেষ পর্যন্ত বিএনপির যেসব নেতা অংশ নেবেন তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হবে বলে দলের নেতারা জানিয়েছেন।
তিন দফায় ক্ষমতায় থাকার পর বিএনপি ২০০৭ সাল থেকে ক্ষমতার বাইরে রয়েছে। এর মধ্যে ২০১৪ ও ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছে দলটি।
দলটির নেতারা বরাবরই দাবি করে আসছেন যে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ পর্যন্ত সারাদেশে দলটির নেতা-কর্মীদের নামে প্রায় দেড় লাখ মামলা হয়েছে। এসব মামলায় বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর ৫০ লাখেরও বেশি নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে বলেও দাবি তাদের। এর মধ্যে প্রায় ২১ হাজার নেতাকর্মী কারাগারে থাকার দাবিও করেছে দলটি।
তবে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা ও কারাগারে থাকার এই সংখ্যা বিবিসির পক্ষে আলাদা করে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তারপরেও এমন প্রেক্ষাপটে উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যেভাবে মাঠ পর্যায়ে সক্রিয় ও জনসম্পৃক্ততা আছে এমন নেতাদের দল থেকে বের করে দিলে দল আরও দুর্বল হয়ে পড়তে পারে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন এমন ঝুঁকি রাজনীতিতে সবসময়ই থাকে।
‘তবে এরা নীতিবর্জিত লোক। এমন লোক কমে গেলে দলের কিছু আসে যায় না। বিএনপির ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা আছে এবং তৃণমূল কর্মীরা আদর্শের জায়গা থেকে সরেনি। তাই দল দুর্বল হওয়া বা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
তার মতে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে যারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে তারা ইতোমধ্যে দল ও কর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ‘এজন্য তাদেরই পস্তাতে হবে, দলকে নয়,’ তিনি বলেন।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলছেন, তাদের দলের মাঠপর্যায়ে- বিশেষ করে জেলা উপজেলায় প্রতিটি পদে একাধিক যোগ্য সংগঠক ও জনপ্রিয় নেতারা আছেন। সে কারণে যারা দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করেছেন তাদের বিদায়ে দলের কোনো ক্ষতি হবে না বলে মনে করেন তিনি।
‘আমাদের দলের মূল লক্ষ্য সরকারের পতন ঘটিয়ে মানুষের ভোটের অধিকার আদায় করা এবং সেজন্য দরকার ত্যাগী নেতার। কেউ একজন চলে গেলে তিনি হারিয়ে যাবেন, তাতে বিএনপির কিছু হবে না। বরং দলের অগ্রযাত্রার জন্য শৃঙ্খলা ও আদর্শ জরুরি। যারা আদর্শ হারিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন দলের তাদের প্রয়োজন নেই। সুতরাং এখানে বিএনপির ক্ষতির কিছু নেই,’ বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেছেন।
যদিও দলের মধ্যে এরও ভিন্নমত আছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নেতা বলেছেন, এই নির্বাচনের সাথে ক্ষমতায় যাবার কোনো সম্পর্ক নেই, বরং অনেক দিন পর দলের স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রিয় নেতাদের ও কর্মীদের এ নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজ নিজ এলাকায় ফেরার সুযোগ তৈরি হয়েছিল।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন বলছেন, সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় নির্বাচনে বিএনপির অনেক নেতা আওয়ামী লীগ আমলেই ভোটে জিতেছেন। উপজেলা পর্যায়েও দলটিতে স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাবশালী অনেকেই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
‘আমার মনে হয় বহিষ্কারের এই সিদ্ধান্তটি বিএনপির জন্য যথাযথ হয়নি। এতে মাঠপর্যায়ে তাদের কর্মীদের মধ্যে হতাশা ও কোন্দল আরও বাড়বে। তবে এটা যদি বিএনপির কৌশল হয় যে মাঠপর্যায়ের জনপ্রিয় নেতারা দলের বাইরে থেকেই তাদের অবস্থান ধরে রাখুক তাহলে ভিন্ন কথা,’ বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন।
তিনি বলেন, প্রধান দুই রাজনৈতিক দলে এমন উদাহরণ অনেক আছে যে, নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কারণে বহিষ্কার হলেও পরে দলই তাদের ফিরিয়ে এনেছে।
প্রসঙ্গত, বহিষ্কৃত নেতাদের অনেকেই সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, নির্বাচনের ফল যাই হোক না কেন তারা বিএনপির সাথেই থাকবেন। অর্থাৎ পরে তারা দলে ফেরার আবেদন করতে পারবেন। তখন তাদের দলে ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগও তৈরি হতে পারে।
সে কারণে প্রার্থী হওয়া নেতাদের দল থেকে বহিষ্কারকে অনেকে বিএনপির কৌশল হিসেবেও বিবেচনা করছেন। যদিও বিএনপি নেতারা এমন বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছেন। -বিবিসি বাংলা