বর্তমান সরকারের গত ১৫ বছর মেয়াদে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের পরেও কেন সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলো না—গণমাধ্যমকর্মীদের এমন প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, 'এভাবে প্রশ্ন করবেন না, খোঁচাবেন না।'
তিনি ওই সাংবাদিকের উদ্দেশে আরও বলেন, 'আপনি আমার জায়গায় বসেন!'
আজ মঙ্গলবার সচিবালয়ে সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে মত বিনিময় করেন ওবায়দুল কাদের।
যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু বাংলাদেশে আসছেন, নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা আছে কি না জানতে চাইলে কাদের বলেন, 'আমি এ নিয়ে কোনো আলোচনা করতে চাই না। উনাদের রুটিন আসা, আসবে-যাবে।'
একজন গণমাধ্যমকর্মী বলেন, বিএনপি গুরুত্ব দিচ্ছে না। সে ব্যাপারে কাদের বলেন, 'তারা কী করছে না-করছে জানি না। তারা উপরে উপরে পাত্তা দেয় না, তলে তলে আবার কী করে সেটা তো বলা মুশকিল।'
তিনি বলেন, 'তিনি (ডোনাল্ড লু) একটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও না। একজন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তাকে নিয়ে বাংলাদেশ এত মাতামাতি করবে কেন! তার প্রয়োজনে সে আসছে, তাদের এজেন্ডা আছে; সম্পর্ক যখন থাকে, সম্পর্কের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা থাকে, সেটা তারা করতে আসছে। আমরা দাওয়াত করে কাউকে আনছি না।'
গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ডোনাল্ড লু এসেছিলেন। ওই সময় নির্বাচনের আগে ভিসা নীতির বিষয়গুলো এসেছিল। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের কোনো রাজনীতিক আসছেন, রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি কীভাবে দেখছেন জানতে চাইলে কাদের বলেন, 'আমরা কোনো প্রকার স্যাংশন-ভিসা নীতি, এগুলো আমরা কেয়ার করি না।'
রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি কীভাবে দেখছেন, আবারও জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বললাম তো, কেয়ার করি না।'
বিএনপি মহাসচিব অভিযোগ করেছেন তাদের নেতাকর্মীদের বিচার করার জন্য পৃথক ট্রাইব্যুনাল করা হচ্ছে। এর সত্যতা জানতে চাইলে কাদের বলেন, 'এটা জ্বলন্ত মিথ্যা। নির্ভেজাল মিথ্যা। এমন কোনো চিন্তা-ভাবনা করিনি।'
এ সময় ডোনাল্ড লুর বাংলাদেশ সফর ও ভিসা নীতির প্রসঙ্গ তুলে প্রশ্ন করা গণমাধ্যমকর্মী আবারও প্রশ্ন করতে গেলে বিরক্তি প্রকাশ করে সেতুমন্ত্রী বলেন, 'আপনি বারবার প্রশ্ন করেন কেন? আপনার প্রশ্নের জবাব দিয়েছি।'
ওই গণমাধ্যমকর্মী জানান, তিনি সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের ব্যাপারে প্রশ্ন করতে চান। গত কয়েক বছর ধরে আপনি রাস্তায় শৃঙ্খলা ফেরানোর বিষয়ে বারবার বলছিলেন, চেষ্টাও করেছিলেন। পারলেন না কেন? জবাবে কাদের বলেন, 'আপনি তো অভিযোগই খালি করতে থাকেন! সব সময়।'
শুক্রবার মেট্রোরেল বন্ধ থাকে—এ ব্যাপারে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত আছে কি না জানতে চাইলে কাদের বলেন, 'এগুলো আলাপ-আলোচনার বিষয়। আমাদের মেট্রোরেল সবেমাত্র আমরা শুরু করেছি। ঢাকায় আমাদের ছয়টি মেট্রো। সেখানে একটি মেট্রো এমআরটি-৬ আমরা শুরু করেছি মতিঝিল পর্যন্ত, সেটা কমলাপুরেও যাবে।'
তিনি বলেন, 'আমাদের টার্গেট হলো ২০৩০। এর মধ্যে ছয়টি মেট্রোর কাজ শেষ করা। এখন মেট্রো একটায় তো সব সুফল পাওয়া যাবে না। আমাদের পরিকল্পনা আছে, সে অনুযায়ী কাজ করছি।'
ঈদের আগে এনবিআরের (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) এক সার্কুলারে জানানো হয়, জুলাই মাস থেকে মেট্রোরেলের ভাড়ায় ১৫ শতাংশ ভ্যাট যোগ হবে। সে সময় আপনি উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। আপনি এনবিআরকে ভ্যাট প্রত্যাহারের কথা বলবেন কি না?
জবাবে কাদের বলেন, 'কয়েক দিন আগে গণভবনে সড়ক ও সেতুর দুটি উপস্থাপনা ছিল। সেখানে আমি ছিলাম এবং নেত্রীকে বলেছি, ভ্যাটের এই ঘোষণা বাস্তবসম্মত না। দুনিয়ার কোনো দেশে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বৃদ্ধির নজির নেই। পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত নজির আছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশেও পাঁচ শতাংশের নজির আছে। এটার যৌক্তিক বিষয়টি নেত্রী বলেছেন, তিনি ভেবে দেখবেন।'
বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) ২০২৪ সালের মধ্যে চালু করার পরিকল্পনা ছিল। এই কাজের অগ্রগতি কতটা জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ওটার কাজ প্রায় শেষ। ওটা এখন কোনো দুর্ভোগের সড়ক নয়। দুই ঈদে আপনারা দেখেছেন, সামনের ঈদেও ওই রাস্তায় কোনো জনদুর্ভোগ হবে—এটা আমরা মনে করছি না। কারণ ওখানে আমাদের প্রয়োজনীয় কাজগুলো হয়ে গেছে।'
সরকার বাস আমদানিতে গুরুত্ব দিচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'আমরা ভালো-টেকসই বাস আমদানির ব্যাপারে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছি দক্ষিণ কোরিয়া, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে। বাসটা আসলেই নভেম্বর-ডিসেম্বরে আমরা বাস র্যাপিড ট্রানজিট চালু করব।'
অনেক পথ এখন আধুনিক হয়ে গেছে, লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা যে গাড়িগুলো এখনো চলছে, সেগুলোর কী হবে? সম্প্রতি যে গতিসীমা নির্ধারণ করা হলো, এটা বাস্তবায়নে কতটা কঠোর উদ্যোগ নেওয়া হবে? আমাদের কোনো ট্রাফিক সিগনালিং সিস্টেম নেই, এটা চালু করার কোনো উদ্যোগ আপনাদের থাকবে কি না—গণমাধ্যমকর্মীরা প্রশ্ন করলে জবাবে কাদের বলেন, 'বাস্তবায়নটাই হলো মূল কথা। আমাদের বিআরটিএর (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ) কিছু ঘাটতি আছে; ঘাটতিটা জনবলের।
'তারপরও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আমরা অত্যন্ত সিরিয়াস। যে সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছি গতিসীমার ব্যাপারে, আমরা কঠোর থাকার চেষ্টা করব। আমরা অংশীজন অনেকেরই প্রশংসা পাচ্ছি,' বলেন সেতুমন্ত্রী।
তিনি বলেন, 'লক্কর-ঝক্কর বাস নিয়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের যে টার্গেট, সেটা নানা কারণে বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। কারণ শুধু একটা মেট্রোরেল দিয়ে গণপরিবহন সংকটের সমাধান করা যাবে না। গণপরিবহনের যে সমস্যা, এর জন্য আরও বাস আমাদের দরকার। যে বাসগুলো এখন রাস্তায় চলে, এর মধ্যে একেবারে আনফিটগুলো আমরা ডাম্পিং করে ফেলি।
'কোনো রকমে চলে এ রকম সব ডাম্পিং যদি আমরা করতে যাই, হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে, তখন আমি এখানে বসলে আপনাদের তরফ থেকে প্রশ্ন আসবে জনগণের দুর্ভোগ হচ্ছে। এটা একটা সমস্যা। বিকল্প ব্যবস্থা না করে আমরা আসলে পারছি না,' যোগ করেন তিনি।
সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ২০ বছরের বেশি পুরাতন বাস তুলে নেওয়া হবে। সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন স্থগিত করে রাখা হয়েছে—এ প্রসঙ্গে সেতুমন্ত্রী বলেন, 'আবার আপনারা বলবেন জনদুর্ভোগ হচ্ছে। সেই কারণে একটু সময় নিচ্ছি।'
তিনি বলেন, 'বিকল্প ব্যবস্থা গণপরিবহনের প্রসার করা। নতুন না এনে পুরাতন একেবারে বাদ দিতে গেলে সমস্যা তো হবেই! এটা বাস্তবতা।'
আপনি গত ১৫ বছর দায়িত্বে থেকেও বলছেন, বিকল্প ব্যবস্থা না করে পুরোনোগুলো সরানো যাবে না। কেন এটা করতে পারছেন না—গণমাধ্যমকর্মীর প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আপনি আমার জায়গায় বসেন! আপনার কথা-বার্তার সুর সব সময় এ রকম। এভাবে প্রশ্ন করবেন না, খোঁচাবেন না।'
অনেকে বলেন আমলা ও সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের কারও গণপরিবহনের চড়ার অভ্যাস নেই বলেই এই বিষয়টি কেউ দেখে না। গণপরিবহনের চড়ার অভ্যাস থাকলে এই সমস্যা থাকতো না। এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী বলেন, 'দেখা-শোনা করছে। আমার সচিব খুব সিরিয়াস। তিনি কঠোর পরিশ্রম করছেন।'
বলার পরও কেন কাজ হচ্ছে না জানতে চাইলে কাদের বলেন, 'কাজ হচ্ছে, একেবারে যে হচ্ছে না তা তো না! কিছু কিছু তো হচ্ছেই। এই শহরে তিনজন মোটরসাইকেলে, কোনো হেলমেট নেই; সেই ছবি কি এখন আছে? এটা পরিবর্তন হয়েছে না!'
আগামী অর্থবছরে কোনো সড়ক থেকে টোল আদায় করা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'নতুন সড়ক হলে হবে।'