ক্ষমতার পালাবদলের দেড় মাস পর ব্যাংক খাতের সংস্কারের অংশ হিসেবে এবার একই দিনে রাষ্ট্রয়ত্ত ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচলককে (এমডি) অপসারণ করেছে বাংলাদেশে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। একই দিনে এতজন এমডিকে সরিয়ে দেওয়ার ঘটনা দেশে এই প্রথম।
বৃহস্পতিবার বিকালে সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বিডিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নিয়োগ বাতিল করে পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। সেই প্রজ্ঞাপনের কপি ব্যাংক ছয়টির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানদের কাছে পাঠানো হয়েছে।
তিন বছর মেয়াদে নিয়োগ পাওয়া এই ছয় এমডির মধ্যে তিন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাত্র এক বছর দায়িত্ব পালন করেছেন।
একসঙ্গে কেন ছয় এমডিকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো– এমন প্রশ্নের জবাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত সচিব অমল কৃষ্ণ মণ্ডল সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “এটা সরকারের বিষয়। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।”
তবে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এই ছয় ব্যাংকে নতুন কোনও এমডি নিয়োগ সংক্রান্ত কোনও প্রজ্ঞাপন জারি করেনি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। নতুন নিয়োগের আগ পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিয়ে ব্যাংকগুলো চলবে বলে জানিয়েছেন আর্থিক বিভাগের কর্মকর্তারা।
ব্যাংক খাতের কর্মকর্তারা বলছেন, আগামী রবিবার নাগাদ এসব পদে নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তুতি রেখেছে সরকার। নতুন কাউকে না পেলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার।
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালককে জানানো হয়েছে। নিয়ম মেনে পর্ষদ বাকি সিদ্ধান্ত নেবে নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ না দেওয়া পর্যন্ত।”
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, ব্যাংকগুলোর পর্ষদ নতুন করে সাজানো হচ্ছে। আগে বদলানো হয়েছে চেয়ারম্যানদের। এরপর বদলানো হয়েছে এবং হচ্ছে পরিচালক অর্থাৎ পর্ষদ সদস্যদের। এবার হাত দেওয়া হয়েছে এমডিদের ব্যাপারে। ভেতরে-ভেতরে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে আওয়ামী লীগের আমলে নিয়োগ পাওয়া কোনও এমডিকেই রাখা হবে না।
ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যানদের উদ্দেশে একই চিঠিতে শুধু যার যার ব্যাংকের এমডির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে বলা হয়েছে, এমডি আফজাল করিমের সঙ্গে পরিচালনা পর্ষদের সম্পাদিত চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের অবশিষ্ট মেয়াদ বাতিলের জন্য সরকারের সুপারিশ/সম্মতি জানানো হলো। তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের অবশিষ্ট মেয়াদ বাতিলের বিষয়ে পরের কার্যক্রম গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
অন্য পাঁচ ব্যাংকের এমডির চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের বিষয়ে চেয়ারম্যানদের কাছে পাঠানো চিঠিতে একই কথা লেখা হয়েছে।
সোনালী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের চুক্তির মেয়াদ দুই বছরের মত অবশিষ্ট ছিল।
কে কোন ব্যাংকের এমডি ছিলেন, কত মেয়াদ বাকি ছিল
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে ২০২২ সালের আগস্টে আফজাল করিমকে নিয়োগ দিয়েছিল আগের সরকার। তিন বছরের জন্য নিয়োগ দেওয়ায় এ পদে এখনও ২৩ মাস মেয়াদ ছিল তার।
সোনালী ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) পদ থেকে আফজাল করিমকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনে নিয়োগ দিয়েছিল সরকার। সেখান থেকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে তাকে ফের সোনালী ব্যাংকে এনে এমডির দায়িত্ব দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার।
২০২২ সালের আগস্টে অগ্রণী ব্যাংকে তিন বছরের জন্য ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন মুরশেদুল কবীর। তারও ২৩ মাস চুক্তির মেয়াদ ছিল। অগ্রণী ব্যাংকে যোগদানের আগে সোনালী ও জনতা ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন কবীর।
২০২২ সালে আগস্টে উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে রূপালী ব্যাংকেই ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর।
আর ২০২৩ সালের মে মাসে জনতা ব্যাংকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান আব্দুল জব্বার। তিন বছরের মধ্যে মাত্র সাড়ে ১৬ মাস দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পেলেন তিনি।
২০২১ সালের এপ্রিল থেকে বেসিক ব্যাংকের এমডি হিসেবে যোগ দেন আনিসুর রহমান। এর আগে তিনি অগ্রণী ব্যাংকের ডিএমডি ছিলেন। এ বছরের ৩১ মার্চ তিন বছরের নিয়মিত মেয়াদ শেষ হলে তাকে আবার এক বছরের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয় গত ১১ এপ্রিল।
২০২২ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (বিডিবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হন হাবিবুর রহমান গাজী। এর আগে তিনি অগ্রণী ব্যাংকের ডিএমডি ছিলেন। মেয়াদ পূরণ হতে আরও আট মাসের মত সময় অবশিষ্ট ছিল তার।
বেসিক ব্যাংক ছাড়া অন্য পাঁচ ব্যাংকের এমডিরা নিয়োগ পেয়েছিলেন তিন বছরের জন্য। ছয় ব্যাংকেই ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছিল গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন হওয়া আওয়ামী লীগ সরকার।
গত ৮ আগস্ট সন্ধ্যায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরই ব্যাংকসহ আর্থিক খাতের নানা খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। প্রায় দেড় মাস সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে গভর্নর, দুই ডেপুটি গভর্নর পদে নতুন মুখ নিয়ে আসে।
বেসরকারি দুর্বল ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়ার পর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের বিষয়ে সর্বশেষ এই সিদ্ধান্ত এল।
ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নিয়োগ দেয় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। বাংলাদেশ ব্যাংক তা অনুমোদন করলে চূড়ান্তভাবে নিয়োগ হয়।
আইন অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নিয়োগ দেওয়ার কাগুজে ক্ষমতা অর্থ মন্ত্রণালয়ের। তবে সরকারের ইচ্ছায় অর্থ মন্ত্রণালয় তা বাস্তায়ন করে।