দুর্গাপূজার দুই সপ্তাহের কিছু বেশি সময় বাকি থাকলেও ভারতের কলকাতাসহ অন্যান্য শহরে জমেনি পূজার কেনাকাটা। ইতোমধ্যে বোনাস হাতে পেলেও ক্রেতাদের ভিড় নেই মার্কেটে। লোকসান এড়াতে ছাড় দেয়ার কথা ভাবছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, বন্যা ও আরজি কর কাণ্ডে ভাটা পড়েছে উৎসবে। নিউমার্কেট থেকে হাতিবাগান, গড়িয়াহাট থেকে ধর্মতলা চত্বর দেখে বোঝার উপায় নেই শারদীয় দুর্গাপূজার আর বেশি দিন নেই।
পূজার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই কলকাতায় শুরু হয়ে যায় কেনাকাটার তোড়জোড়, ক্রেতাদের আনাগোনায় মুখর হয়ে ওঠে বাজারঘাট। কিন্তু এবার শারদীয় দুর্গোৎসব ঘিরে কোনো ব্যস্ততা নেই পশ্চিমবঙ্গবাসীর। বিশেষ করে ছোট ব্যবসায়ীরা পূজা উপলক্ষ্য বড় অংকের বিনিয়োগ করেন, ক্রেতা শূন্য বাজার দেখে তাদের কপালে চিন্তার ভাজ।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর ভিসা বন্ধ করছে ভারত। পর্যটন শূন্য কলকাতা। আরজি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক নারী চিকিৎসককে নৃশংসভাবে ধর্ষণের পর খুনের ঘটনায় গত দেড় মাস ধরে চলছে আন্দোলনের ধর্ণা ও মিছিল। এই পরিস্থিতি শেষ হতে না হতেই, পশ্চিমবঙ্গজুড়ে শুরু হয়েছে ‘ম্যান মেড’ বন্যা। ডুবেছে তিন জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। দুই বাংলার প্রভাব পড়েছে কলকাতাসহ আশপাশের জেলার বাজার অর্থনীতি। ক্ষতির পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি। বন্যা নিয়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে গলা চড়িয়েছেন মমতা বন্দোপাধ্যায়।
আরজি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জুনিয়র চিকিৎসক ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার নায্য বিচারের দাবিতে লাগাতার আন্দোলনে মুখ থুবড়ে পড়েছে কলকাতাসহ আশপাশের জেলাগুলোর অর্থনীতি। করোনার মত মহামারী ছাড়া হেরিটেজ তকমা পাওয়া পুজো মৌসুমের ব্যবসা ইতিহাসে এমন ঘটনা অতীতে ঘটেনি।
নিম্নচাপ ও বেশি বৃষ্টিপাতের আগাম আভাস পেয়ে সময়ের অনেক আগেই কুমোরটুলির শিল্পীরা দূর্গা প্রতিমা তৈরি শুরু করেছিলেন। অর্থনীতির চাকার গতি বাড়াতে ক্লাবগুলোকে পুজোর অনুদান বরাদ্দ বাড়িয়ে ৮৫ হাজার টাকা ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
নানা থিমের মন্ডপ তৈরির বাঁশ বাধার কাজও শুরু করেছিলেন পুজো কমিটিগুলো। কিন্ত সব ওলোট পালোট করে দিয়েছে গত ৯ আগষ্টের রাত। আরজি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও খুন হন তরুনী চিকিৎসক ‘তিলোত্তমা’। এই ঘটনায় ক্ষোভে ফেটে পড়ে গোটা রাজ্য।
সব দোষীদের গ্রেফতার না করায় তদন্তের গাফিলতির সাথে প্রকাশ্যে আসে রাজ্যের চিকিৎসা পরিকাঠামো পদ্ধতির দূর্নীতি। শহর থেকে গ্রাম সর্বস্তরের মানুষ রাজপথে নেমে দাবি করে ‘উয়ি ওয়ান্ট জাস্টিস’। গেলো একমাস ধরে চলছে বিচার চাওয়া আন্দোলন । পাঁচ দাবি মেনেও স্বস্তিতে নেই রাজ্য সরকার।
বিগত বছরগুলোতে এই সময় ক্রেতাদের ভিড় ও কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকত কলকাতার নিউমার্কেট, গড়িয়াহাট, শিয়ালদা,বড়বাজারের দোকান মলে । চলতি মরসুমে পুজোর কেনাকাটা বাদ দিয়ে গত এক মাস ধরে দুপুরের পর থেকে রাত পর্যন্ত কলকাতা ছাড়াও রাজ্যের বিভিন্ন শহরের রাস্তায় নেমেছে প্রতিবাদী মানুষ।
ফলে পশ্চিমবঙ্গের শতাধিক বাজার ইতিমধ্যে কয়েকশ’ কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছে। কেনাকাটা করতে না আসায় মাছি তাড়াচ্ছেন হোটেল রেস্তোরাঁর ব্যবসায়ীরাও।
কলকাতার বাজারের সবচাইতে বড় একটি অংশ বাংলাদেশী পর্যটকদের শুন্যতায় এবার পুজার বাজারে ভাটা পড়ার বিষয়টি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর ভিসা জটিলতায় পশ্চিমবঙ্গে কমেছে পর্যটকের সংখ্যাও। উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা ছাড়াও কলকাতার বস্ত্র বাজারগুলো বাংলাদেশি ক্রেতাদের না পেয়ে দিশেহারা ব্যবসায়ীরা এখন আন্দোলনের কোপে পড়ে কোটি কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছেন। তার ওপর অবৈধ বাংলাদেশিদের ঝুলিয়ে রাখার হুমকিতে অস্বস্তিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, কোভিড সময়কালীন বাংলাদেশী ক্রেতার অভাবে কলকাতার অনেক ব্যবসায়িকেই পেশা পরিবর্তন করতে হয়েছে। তেমনি করেই এবারো সেই সঙ্কট নতুন করে তৈরী হচ্ছে।
রাজ্যের বাজার অর্থনীতির চাকা সচল করতে উৎসবে ফেরার বার্তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। টলিউডের শিল্পী থেকে মফস্বলের প্রতিবাদীরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। উল্টে বিচার চেয়ে উৎসব পালনের ডাক দিয়ে পথে নেমেছেন তারা । শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) বেঙ্গল শপিং ফেস্টিভ্যালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অডিওবার্তায় আরও একবার পুজোর গুরুত্ব মনে করিয়ে দিয়ে মমতা বলেন, উৎসবের বেচাকেনার সাথে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অনেকের ভাগ্য জড়িত। মমতা বলেন, ‘যেহেতু বর্ষায় কয়েকটা দিন ব্যবসার ক্ষতি হয়েছে। তাই আমি মনে করি ছোট হকার থেকে শুরু করে দোকানদার,বড় দোকানদার, যারা এইসব পুজোকে কেন্দ্র করে সারাবছরের একটা ব্যবসা করে, যেন সারাবছর তাদের ইনকামের রাস্তা অনেকটা খুলে যায়।’
একজন বিক্রেতা বলেন, ‘নানারকম পারিপার্শ্বিক রাজনৈতিক কারণে ব্যবসাটা খারাপ হয়েছে। ব্যবসা আর আগের মতো নেই।’ ক্রেতারা বলছেন, বন্যার কারণে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত অনেক পরিবারের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ নেই। আবার অবস্থাপন্ন ক্রেতাদের কেউ কেউ বাড়ির কনিষ্ঠ সদস্যের জন্যে কেনাকাটা করতে আসলেও, পারিপার্শ্বিক নানা কারণে নিজেদের জন্য কিছু কিনছেন না। একজন ক্রেতা বলেন, ‘কেনাকাটা তো করতে হবেই। আবার বাড়িতে বাচ্চা আছে। এখন তো সবারই একটা খারাপ অবস্থা যায়। তাও বাচ্চাদের খুশি করার জন্য তো কেনাকাটা করতেই হয়।’
ফুটপাতের দোকানি থেকে নামিদামি শপিংমল, পূজার এই সময়টার জন্য মুখিয়ে থাকেন সবাই। অনেক নিম্নবিত্ত পরিবারের সংসার চলে তৈরি পোশাক, পূজার মণ্ডব সজ্জায় ব্যবহৃত সরঞ্জাম ইত্যাদি বানিয়ে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা আর জি কর-কাণ্ডের জেরে এবার সীমিত আকারে পূজা উদযাপনের ঘোষণা দিয়েছে অনেক ক্লাব ও পাড়ার পূজা কমিটিগুলো। তবে, এত কিছুর মধ্যেও আগামী দুই সপ্তাহে জমে উঠবে কলকাতার পূজার বাজার- এমনটাই প্রত্যাশা ব্যবসায়ীদের।